লেখক: রফিকুল ইসলাম

জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বিশিষ্ট মননশীল লেখক, ভাষাতত্ত্ববিদ, নজরুল বিশেষজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল গবেষনা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক- বিশাল ক্যানভাসে বিপুল তাঁর কর্মযজ্ঞ। একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ববঙ্গে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে নতুন স্ফুরণ হয়েছিল। রফিকুল ইসলাম সেই অবিনাশী চেতনা ধারন করে মানুষের আত্মিক মুক্তি, সৃজনশীল বিকাশ এবং মৌলিক অধিকারের বিষয় নিয়ে রচনা করেছেন প্রায় ৬৫টি অনবদ্য গ্রন্থ।

ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানী মানবতাবাদী লেখক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভাষা ও ইতিহাস নিয়ে তাঁর পড়াশুনার ব্যাপ্তি ছিল গভীর এবং এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন জীবনভর। একই সাথে চলমান রাজনীতির প্রতি ও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটির চেতনার গভীরে ছিল বাঙালির সমন্বয়বাদী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।

জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ও জাতীয় জনমানসের বিবর্তনকে তিনি নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। যা জাতির বিবেককে জাগায়। জাতিকে সামনের দিকে তাকাতে শেখায়। বৈজ্ঞানিক সত্য অন্বেষণ ধারণ করে ধর্মান্ধতাকে তিনি অনায়াসে সাহসের সাথে পৃথক করে রাখতে পেরেছেন। বিনয়, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতা ছিল রফিকুল ইসলামে স্বভাবধর্ম। এর অভ্যন্তরে সক্রিয় ছিল তারঁ ছয় আদর্শবাদ।

রফিকুল ইসলাম প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট না থেকেও তিনি সমাজের সব আন্দোলন, সংগ্রামের সাথে একাত্ম হয়ে চলমান নানামাত্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংকট ও উত্তরণের উপায় নিয়ে রচনা করেছেন প্রবন্ধ, নিবন্ধ।

তিনি বিশ্বাস করতেন ‘শিল্পের জন্য শিল্প নয়’ জীবনের জন্যই শিল্প। জীবনানুগ শিল্পবোধ রফিকুল ইসলামের চেতনা, মনন ও বিশ্বাসের আকর ছিল। তাই তিনি জীবন ও লেখক সত্তাকে আলাদা করে কখনো দেখেননি। সাহিত্যের সরলতা তাঁর লেখনির পরতে পরতে ছিল। তাঁর লেখনির ভাষা জোরালো এবং রচনা শৈলীতে রয়েছে গভীরতা, ব্যাপ্তি এবং তীব্র ভাব ঐশ্বর্য।

শব্দ সৃজনের পরীক্ষা নিরীক্ষা, রচনাশৈলীর বিচিত্রতা বানানের সংস্করণ, প্রানবন্ত ভাষাকে গতি ও ভাবকে দ্যুতি দেবার জন্য এবং শব্দসৃজনের ব্যাপকতা আনার জন্য রফিকুল ইসলাম রচনা করেছেন বাংলা ব্যাকরণ সমীক্ষা, সহস্রাব্দের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য, প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থ।

মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ রফিকুল ইসলামের লেখক মানসকে প্রভাবিত করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে জাতির জাগরণের কথা, যুদ্ধকালীন সময় সাধারণ মানুষের অনন্য সাধারণ উদ্দীপনা, উজ্জল কীর্তি, যুদ্ধকালীন সময় বাংলার রূপ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেছেন লেখনির মাধ্যমে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঠিক ইতিহাস।  মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাষ্ট্র বাঙালির গর্ব। বাঙালির জাতিসত্তা বিনির্মাণে বিশাল অবদান রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। যতদিন এই বসুধায় বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন মুক্তিযোদ্ধারা জাতির প্রেরণার  উৎস হয়ে থাকবে। এই অসীম বীরত্বের গাথাঁ নিয়ে তিনি রচনা করেছেন : সম্মুখ সমরে বাঙালী, বীরের এ রক্ত¯স্রোত মাতার এ অশ্রুধারা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র, স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রভৃতি গ্রন্থ।

একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সমতাভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। শুধু স্বপ্ন দেখানো নয় তা বাস্তবায়ন ও করেছেন মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিস্মরনীয় এই মহামানবকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে রফিকুল ইসলাম রচনা করেছেন স্মরনে শেখ মুজিব সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালি

নজরুল গবেষক, নজরুল অধ্যাপক, রফিকুল ইসলামের নজরুলের উপরে রচিত গ্রন্থগুলি বিষয় বৈচিত্র্যে বর্ণনায়, কথনে, বিন্যাসে যেমন স্বাতন্ত্র্য রয়েছে তেমনি নতুনত্বের শৈল্পিক ছন্দে সমৃদ্ধ। তিনি আজীবন নজরুলের বৈপ্লবিক সৃজনশীলতার অভিজ্ঞতা লালন করেছেন। চর্চা করেছেন। জীবন থেকেই জীবনের পাঠ নিয়ে আপন স্বকীয়তায় উজ্জল হয়ে লিখেছেন: নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃষ্টি, নজরুল জীবনী, নজরুল সাহিত্য, শতবর্ষে নজরুল, নজরুলের বাংলাদেশ আগমনে শতবর্ষ, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ স্মারক, Biography of Kazi Nazrul Islam, Kazi Nazrul Islam: A New Anthology.

ঢাকা একটি প্রচীন শহর। ১৯১০ সালে ঢাকা বঙ্গের রাজধানী স্থাপনের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার ঐতিহ্যের গৌরব নিয়ে তিনি রচনা করেছেন ইতিহাস ভিত্তিক গ্রন্থ ঢাকার কথা

রফিকুল ইসলামের লেখনিতে রয়েছে সমাজের ইতিহাস ব্যাক্তির অভিযাত্রা, চলার পথে আত্মিক সংকট, আন্দোলন সংগ্রামের উত্তরণের অভিযাত্রা। তাঁর সুললিত ভাষা এবং অপূর্ব প্রকাশভঙ্গি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মত আকৃষ্ঠ করে।

বলিষ্ঠ লেখনি ও বর্ননার গোষ্ঠির বিবেচনায় তিনি মৌলিক বৈশিষ্ঠ্যে উজ্জ্বল। তাঁর জীবনাচরণ ও জীবন যাত্রার সঙ্গে সাহিত্যের যোগসূত্র নির্ণয়ের মানদন্ড হয়ে ওঠে সমকালীন।

প্রানপ্রাচুর্যে ভরপুর, উদার, আদর্শনিষ্ঠ, সহজ, সরল মানুষটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। আগুনের পরশমনি ছুঁইয়ে রফিকুল ইসলাম আমাদেরকে আলোর পথের সন্ধান দিয়েছেন।

-অধ্যাপক কাজী মদিনা